Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ইসলামে ‘ওহী’র তাৎপর্য, ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ

ইসলামে ‘ওহী’র তাৎপর্য, ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ

।। মুফতি আবু সাঈদ ।।

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। এই কুরআন মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী হওয়ার ব্যাপারে সামান্যতমও সন্দেহের অবকাশ নেই। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এ কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে ওহীর মাধ্যমে এবং এটা তাঁর মো’জেযাসমূহের অন্যতম এক মো’জেযা, তাই ওহী সম্পর্কে কিছু কথা লিপিবদ্ধ করা প্রসঙ্গত দাবি রাখে।

ওহী কী ও কেন?

মহান প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা মানুষ এবং জিন জাতিকে এই পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাসের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এর একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল- তারা যেন আপন প্রতিপালকের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْاِنْسَ اِلَّا لِيَعْبُدُوْنَ “আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এ জন্য যে, তারা যেন আমারই ইবাদত করে।”  (সূরা- যারিয়াত- ৫৬)।

পৃথিবীতে বসবাস করে মহান আল্লাহর ইবাদত করার বিষয়টি বিশুদ্ধ জ্ঞান ও ইলম অর্জন করা ব্যতীত সম্ভব নয়। কারণ, সে এখানে কীভাবে জীবন যাপন করবে, কোন জিনিস কীভাবে ব্যবহার করবে, কোন বস্তু তার জন্য উপকারী, কোনটি তার জন্য ক্ষতিকর। তেমনিভাবে মহান আল্লাহর নির্দেশ কী, তাঁর নিষেধাজ্ঞা কোন জিনিসে? কোন কাজে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকেন, কোনটিতে তিনি অসন্তুষ্ট হোন। এসমস্ত বিষয়াদি জানতে হলে সঠিক জ্ঞান ও ইলমের প্রয়োজন। কেননা কোন কাজ করার পূর্বে সে বিষয়ে জানা আবশ্যক।

তাই আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনটি অনন্য বস্তু তাদেরকে দান করেছেন। এক. পঞ্চেন্দ্রিয়: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। দুই. বিবেক বা বোধশক্তি। তিন. ওহী।

মানুষ তার পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনেক অজানা জ্ঞানের সন্ধান পায়। তেমনি সে তার বিবেক বা বোধশক্তির মাধ্যমেও সুপ্ত ও গুপ্ত জ্ঞানের বিচিত্র ভা-ারকে আবিষ্কার করতে পারে।

তৃতীয়টি হচ্ছে ওহী! এটা মানুষের বোধশক্তি ও পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত জ্ঞানের চেয়েও আরো ঊর্ধ্বতন জ্ঞানের সন্ধান দেয়। অর্থাৎ জাগতিক বিষয়ে যদিও পঞ্চেন্দ্রিয় ও বোধশক্তি প্রয়োগ করে কোন একটি সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টির বিষয়টি উপলব্ধি করা কারো পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ওহী- যা তিনি তাঁর নির্বাচিত কোন নবীর নিকট প্রেরণ করেন।

জ্ঞান অর্জনের এই তিনটি মাধ্যমের মাঝে রয়েছে শ্রেণী বিন্যাস। প্রত্যেকটির রয়েছে নির্দিষ্ট একটি পরিধি ও সীমানা। নিজ সীমানা বা গণ্ডির বাহিরে সেটি কাজ করতে পারে না। অর্থাৎ যে জ্ঞান পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জন করা যায়, তা শুধু বোধশক্তি তথা বিবেক দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ: একটি কলম। যা আপনি চোখে দেখেছেন, এই দেখা দ্বারা আপনার এ জ্ঞান অর্জন হল যে, কলমটির রঙ ‘কালো’। কিন্তু আপনার চোখ বন্ধ অবস্থায় একটি কলম আপনার সামনে রাখা হলে, আপনি আপনার বোধশক্তি বা বিবেক খাঁটিয়ে এই জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন না যে, আপনার সামনে রাখা কলমটির রঙ ‘কালো’।

বিবেক তথা বোধশক্তির মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করা যায়, তা কিন্তু পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। যেমন, বিবেক তথা বোধশক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা ছাড়া শুধু একটি কলমের দিকে আপনি তাকালেন, আপনার এই তাকানোর দ্বারা এ জ্ঞান অর্জন হবে না যে, ঐ কলমটির কোন একজন প্রস্তুতকারক রয়েছে; বরং চোখের দৃষ্টির সাথে সাথে প্রয়োজন হবে বিবেক তথা বোধশক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা। তাহলেই এর যে একজন প্রস্তুতকারক রয়েছে, সেই জ্ঞানটি আপনার অর্জিত হবে।

জ্ঞানের কিছু শাখা এমন রয়েছে যেগুলো পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কিংবা বিবেক দ্বারা উপলব্ধি করে অর্জন করা যায় না। যেমন, একটি কলম। এখন এর দ্বারা কী লিখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকবেন, আর কী লিখলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন?

এই কলম দ্বারা চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের পক্ষে লিখলে কী হবে? কিংবা নিরপরাধীদের বিপক্ষে লিখলে কী হবে? একজন বিচারপতি তার কলমে লিখিত রায়ে কাকে অপরাধী সাব্যস্ত করবেন? কাকে নির্দোষ প্রমাণিত করবেন? হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের রায় লিখবেন, নাকি তাকে ক্ষমা করে দিবেন?

এগুলো এমন কিছু প্রশ্ন- যদি এগুলোকে মানুষের বিবেক বা বোধশক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বিবেক সেগুলোর সমাধান দিতে হিমশিম খেয়ে যায় এবং দিশেহারা হয়ে যায়।

যেমন- অন্যায়ভাবে কোন এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে আসামীকে কাঠগড়ায় দাঁড়ালো। এখন এর সমাধানের জন্য শুধু বিবেককে কাজে লাগালে বিবেক এক পর্যায়ে যে সমাধানে উপনীত হবে, তা হলোÑ সেই আসামী যেহেতু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে নিহতের স্ত্রীকে বিধবা করেছে, তার ছেলে-মেয়েকে এতিম করেছে। তাই বিচারপতির পক্ষ থেকে তার হত্যার নির্দেশ দেওয়া উচিত। অর্থাৎ বিচারপতির কলমে তার ফাঁসির রায় হওয়া চাই। যাতে অন্যরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

অন্যপর্যায়ে বিবেক বলবে- আচ্ছা, যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে এখন যদি তার হত্যাকারীকে ফাঁসির রশিতে ঝোলানো হয়, তাহলে তো আর সেই মৃত ব্যক্তি জীবন ফিরে পাবে না। তার স্ত্রীও নিহত স্বামীর সুখ পাবে না, ছেলে-মেয়েরাও পিতার স্নেহ-মমতা পাবে না! বরং নিহতের হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে হত্যাকারীর স্ত্রী-সন্তানরাও আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে, অথচ তারা নিরপরাধ।

সুতরাং এই নির্দোষ ব্যক্তির ব্যাপারে বিচারকের কলম দ্বারা এমন কোন রায় না হওয়া চাই, যার কারণে কিছু নিরপরাধ ব্যক্তি আশ্রয়হীন হয়ে বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হয়ে পড়ে।

দেখুন! উপরিউক্ত দু’টি যুক্তিই কিন্তু বিবেক প্রসূত। এখানে বিচারকের বিবেক উক্ত হত্যাকারীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করবে, না তার মুক্তির ফয়সালা দিবে?

এখানে বোঝা যাচ্ছে এসকল বিষয়ের সমাধানে বিবেক যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে না, অনুরূপভাবে পঞ্চেন্দ্রিয়ও এর সঠিক সমাধানে উপনীত হতে ব্যর্থ! সুতরাং সঠিক ও বিশুদ্ধ সমাধানের জন্য প্রয়োজন হবে মহান সৃষ্টিকর্তার দিক-নির্দেশনা, যাকে পরিভাষায় ‘ওহী’ বলা হয়।

ওহীর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের নিয়ম হলো- মহান আল্লাহ তাঁর পছন্দনীয় কোন বান্দাকে নবী বানিয়ে তাঁর ওপর নিজের বার্তাদেশ অবতীর্ণ করেন। সেই জ্ঞান দ্বারাই সঠিক ও বিশুদ্ধ সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব।

উক্ত আলোচনায় দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়-

১. পঞ্চেন্দ্রিয় বা শুধু বিবেক দ্বারা সমস্ত জ্ঞান অর্জন করা এবং এর দ্বারা বিশুদ্ধ সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজন ওহীর জ্ঞান।

২. ওহীর কাজ শুরু হয় বিবেকের পরে, যেখানে বিবেক পথ দেখাতে পারে না, সেখান থেকে ওহী পথ দেখায়।

এখান থেকে যে বিষয়টি পরিস্ফুট হয়, তা হলো- ওহীর সব কাজ বিবেকের নিকট বোধগম্য হওয়া জরুরি নয়। তাই দ্বীনের যে সকল বিষয় ওহী দ্বারা প্রমাণিত, সেগুলোর মধ্যে শুধু বিবেক তথা যুক্তির ওপর ভরসা করে কোন সমাধান বের করতে চাওয়া এক অযৌক্তিক বিষয়।  (মারিফুল কুরআন, মুফতী শফী রহ.- ১/২১-২২; তাওযিহুল কুরআন, জাস্টিস তকী উসমানী- ১/১৩-১৫)।

ওহীর যৌক্তিকতা

যারা আল্লাহকে স্বীকার করে, তাদের জন্য ওহীর যৌক্তিকতা এবং এর বাস্তবতা উপলব্ধি করা কঠিন কিছু নয়। আপনি যদি এ কথা বিশ্বাস করেন যে, এই বিশাল জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। তাঁর নিপুণ ব্যবস্থাপনাতেই সমস্ত সৃষ্টিজগত পরিচালিত হয়। তিনি একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ পৃথিবীতে মানুষ প্রেরণ করেছেন। তাহলে তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব (!) যে, তিনি পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়ে তাকে কোন দিক-নির্দেশনা না দিয়ে অযথাই তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকারে ছেড়ে দিবেন!

পৃথিবীতে মানুষ পাঠানো হলো- এখানে তার দায়িত্ব কী? কী তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য? কীভাবে সে তার নিজের জীবনকে পরিচালনা করে কাঙ্খিত সফলতায় উপনীত হবে? সৃষ্টিকর্তা এসকল বিষয়ে কোন নির্দেশনাই তাকে দিবেন না, তা কী করে সম্ভব?!

আরও পড়তে পারেন-

একজন বিবেকবান মানুষ তার অধীনস্তকে কোন কাজে পাঠাবেন- কিন্তু কোথায় পাঠাবেন? কেন পাঠাবেন? যাত্রা পথে সে কীভাবে চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কোন দিক-নির্দেশনা তিনি নিজেও বলে দিবেন না। কিংবা কারো মাধ্যমে তার অধীনস্তকে জানিয়ে দেয়া হবে না! এটা কি কোন বিবেকবানের কাজ হতে পারে?

যদি তাই হয়, তাহলে প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তা‘আলা- যিনি সমস্ত জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুই যিনি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর পক্ষে এ বিষয়টি কীভাবে সম্ভব হতে পারে যে- তিনি মানুষ সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠালেন, কিন্তু তার জীবন পরিচালনার কোন বার্তাই তাকে দিবেন না, এটা কি কখনও হতে পারে!!

সৃষ্টিকর্তা তাঁর বান্দাকে জীবন পরিচালনার যেই দিক-নির্দেশনা দিবেন তার নামই ওহী। যা যুগে যুগে নবীগণের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের নিকট প্রেরণ করেছেন।

সর্বশেষে তাঁর শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহীর মাধ্যমে (কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানবজাতির জন্য) এই মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন অবতীর্ণ করে ওহীর সেই ধারাবাহিকতার পথ সমাপ্ত ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। (মাআরিফুল কুরআন- ১/২২, -২৩)।

ওহীর প্রকারভেদ

সময় ও অবস্থাভেদে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহী এসেছে। যা নিম্নরূপ-

এক. ঘণ্টার শব্দের মতো লাগাতার ও বিরামহীনভাবে চারদিক থেকে আওয়াজ শোনা যেত।

হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত- একবার হযরত হারেস ইবনে হিশাম রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, (হে আল্লাহর রাসূল!) আপনার নিকট ওহী কীভাবে আসে?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কখনো ঘণ্টার আওয়াজের মতো শোনা যেতে থাকে, কিন্তু ওহীর এই পদ্ধতিটি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হয়ে যায়।

উক্ত আওয়াজের ধারাবাহিকতা শেষ হলে তাতে যা কিছু বলা হয়ে থাকে, তা আমার স্মৃতিশক্তিতে বদ্ধমূল হয়ে যায়। কিন্তু কখনো আবার ওহীবাহক ফেরেশতা কোন মানব পুরুষের আকৃতি ধারণ করে ওহী নিয়ে এসে থাকেন। (সহীত বুখারী, হাদীস- ২)।

দুই. হযরত জিবরাঈল আ. কোনো মানব আকৃতিতে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহপ্রদত্ত বার্তা শুনাতেন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় প্রসিদ্ধ সাহাবী দিহইয়া কালবী রাযি. এর আকৃতিতে আগমন করতেন। কখনো আবার অন্য কারো আকৃতিতেও আসতেন। ওহীর এই পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য সবচেয়ে সহজ ছিল। (সহিহ বুখারী, হাদিস- ২; ফাতহুল বারী: ১/২৬; ইরশাদুস সারী: ১/৮৫; আল ইতকান: ১/৫৩; মারিফুল কুরআন- ১/২৪)।

তিন. হযরত জিবরাঈল আ. কোন মানুষের আকৃতি অবলম্বন করা ব্যতীত নিজ আকৃতিতেই এসে আল্লাহর বাণী পৌঁছাতেন। তবে এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে মাত্র তিনবার হয়েছে-

১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত জিবরাঈল আ.-কে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখার ইচ্ছা করেছিলেন। ২. মে’রাজের সময়। ৩. নবুওয়াত প্রাপ্তির শুরুর দিকে পবিত্র মক্কার আজয়াদ নামক স্থানে। ৪. কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলা। এটা জাগ্রত অবস্থায় মে’রাজের সময় হয়েছে। তবে স্বপ্নেও একবার হয়েছে।  ৫. জিবরাঈল আ. কোন আকৃতি ধারণ করা ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে কোন কিছু ঢেলে দেন। 

ওহী প্রেরণের সময় সতর্কতা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে শয়তানরা মেঘমালা পর্যন্ত গমন করত। আল্লাহ তা‘আলা যখন আসমানে কোন ফরমান জারি করতেন, ফেরেশতাগণ নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করবার জন্য নিজেদের পাখা মারতেন। ফরমান শেষ হলে তাঁরা পরস্পরে আলোচনা করতেন। তারপর ফেরেশতারা হয়তো আলোচনা করতে করতে মেঘমালা পর্যন্ত চলে আসতেন। আর আসমানী খবরচোরা সেই শয়তানরা সেখানে ওঁত পেতে থাকত এবং তাঁদের থেকে কোন কিছু শুনে তার মধ্যে আরো মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গণকদের নিকট পৌঁছে দিত।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  নবুওয়াত  প্রাপ্তির পর ওহীর হেফাজতের জন্য এ ধরনের চুরির সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোন শয়তান খবর চুরি করতে উপরে গেলে তাকে জ্বলন্ত উল্কাপি- মেরে প্রতিহত করা হত। এরপর যখন ওহীবাহক ফেরেশতা ওহী নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসতেন, তখন ওহীবাহক ফেরেশতা এবং তাঁর চতুর্পার্শ্বে চারজন ফেরেশতা কড়া প্রহরায় থাকতেন। শয়তান যাতে এর মাঝে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে।

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন- আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে ফেরেশতার মাধ্যমে হেফাজত করেন। যাতে তাঁরা তাঁদের মহান দায়িত্ব আদায়ে সফল হন এবং তাঁদের নিকট প্রেরিত ওহী সর্বদিক দিয়ে সংরক্ষিত থাকে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর- ৪/৫৫৬; সফওয়াতুত তাফাসীর- ৩/৩৩৮)।

বিশিষ্ট তাফসীর বিশারদ মুকাতিল রহ.-সহ আরো অনেক মুফাসসিরগণ বলেন- মহান আল্লাহ যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেন, ইবলিস-শয়তান তখন তাঁর নিকট ফেরেশতার আকৃতিতে আসে। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলের চতুর্পার্শ্বে ফেরেশতাদের প্রহরা কায়েম করেন। তাঁরা তাঁকে পাহারা দেন এবং শয়তানকে প্রতিহত করেন।

 শয়তান যখন তাঁর নিকট ফেরেশতার আকৃতিতে আসে, পাহারারত ফেরেশতাগণ বলে দেন, সে শয়তান। এর থেকে সতর্কতা অবলম্বন করুন। আর কোন বার্তাবাহক ফেরেশতা আসলে বলে দেন, তিনি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতা। (তাফসীরে মাজহারী- ১০/৬২)।

পাহারারত এসকল ফেরেশতা ছাড়াও বিশেষ কিছু সূরা বা আয়াত অবতরণের  সময় অতিরিক্ত আরো অনেক ফেরেশতা উপস্থিত থাকতেন। যেমন-

১. সূরা ফাতেহা অবতরণের সময় ৮০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন। ২. সূরা কাহাফ অবতরণের সময় ৭০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন। ৩. সূরা আনআম অবতরণের সময় ৭০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন। ৪. সূরা ইউনুস অবতরণের সময় ৩০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন। ৫. সূরা বাকারার আয়াতুল কুরসি অবতরণের সময় ৩০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন। ৬.  সূরা যুখরুফের কতিপয় আয়াত অবতরণের সময় ২০ হাজার ফেরেশতা উপস্থিত ছিলেন।

উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, আসমান থেকে নিয়ে নবীগণের নিকট ওহী পৌঁছানো পর্যন্ত এই ওহীর সংরক্ষণের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে সর্বদিক থেকে শয়তানের কবল থেকে সংরক্ষণ থাকে এবং তার বিশুদ্ধতায় সামান্যতমও সন্দেহের অবকাশ না থাকে।

ওহী অবতরণের সূচনা

প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম বুখারী রহ. আম্মাজান হযরত আয়শা রা. এর সূত্রে তাঁর বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ’ বুখারী শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহী অবতরণের সূচনা হাদিসটি বর্ণনা করেন-

প্রথম প্রথম ওহী আসে স্বপ্নে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে স্বপ্নে যা দেখতেন, দিনের বেলায় তা স্পষ্ট প্রতিভাত হত। এতে তিনি প্রাণবন্ত হতেন। দিনভর ভাবতেন। আর আঁধার কেটে এক আলোর সূচনা হবে সেই বিশ্বাস তাঁর হৃদয়ে জন্ম নিতে থাকে।

সময়ের ব্যবধানে সেই মহামানব একাকীত্ব প্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রভুর স্মরণে নির্জন স্থানে চলে যেতেন তিন মাইল দূরে অবস্থিত সেই জাবালে নূরের হেরা গুহায়। যেখানে বসে কা’বা শরীফ দেখা যেত। প্রভুর ধ্যানে দিন-রাত একাকার হতো সে গুহায় বসে কা’বা দর্শনে। এভাবেই রাতের পর রাত অতিবাহিত হতে থাকল সেই পাহাড়ের নিঝুম গুহায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দিবসে চমকিত হলেন। যেখানে কোন মানবের সাড়া নেই, শব্দ নেই। সে গুহায় হযরত জিবরাঈল আ. উপস্থিত হয়ে বললেন- ‘ইকরা’ ‘পড়ুন’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ‘আমি তো পড়তে জানি না, পড়বো কীভাবে?’

হযরত জিবরাঈল আমিন আমার এই না-সূচক জবাবে আমাকে তাঁর বুকে জড়িয়ে এই পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে আলিঙ্গন করলেন, আমি কষ্টের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হলাম। ছেড়ে দিয়ে একই নির্দেশ- ‘ইকরা’ ‘পড়ুন’। জবাবে আমি দ্বিতীয় কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। বলতে লাগলাম- ‘আমি তো পড়তে জানি না’।

এ কথা শুনে আমাকে দ্বিতীয় বারও তাঁর বুকে জড়িয়ে প্রথম বারের মতোই সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এতে আমার বাহুবল একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ল। এবারও ছেড়ে দিয়ে একই নির্দেশ- ‘ইকরা’ ‘পড়ুন’। আমি আবারও বললাম- ‘আমি তো পড়তে জানি না।’

তৃতীয় বারও একই আলিঙ্গন শেষে ঐতিহাসিক সেই মহাবাণী পাঠ করতে লাগলেন-

اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ (১) خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ (২) اِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ (৩) الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ (৪) عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ (৫)

“আপনি পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপি- থেকে। পাঠ করুন এবং আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে (এমন জ্ঞান) যা সে জানতো না।”

এর সূচনাতেই রচিত হলো শেষ যুগে এক নতুন ইতিহাস। নতুন বিধানে, নতুন আলোতে পৃথিবী যেন ফিরে পেল হারানো যৌবনের সজীবতা। আর এ মহাসত্যের জয়গানেই নিরসন হল সকল অসারতা।

– মুফতি আবু সাঈদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। খতীব- বারীয়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।